আমার অভিজ্ঞতায় বিড়ালের ফ্লু

আমার অভিজ্ঞতায় বিড়ালের ফ্লু

বিড়ালের জন্য অন্যতম ভয়ানক অসুখ হচ্ছে ফ্লু বা FPV (Feline Panleukopenia Virus)। এই ফ্লুতে আক্রান্ত বিড়ালের চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা না হলে এবং বিড়ালের ইমিউনিটি দূর্বল হলে বিড়ালের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। সম্প্রতি বিড়ালের প্রাণঘাতী এই অসুখের অভিজ্ঞতা নিতে হল আমাকে।

এপ্রিল মাসের শুরুতে আমার মেয়ে বিড়াল টুকি দ্বিতীয়বারের মতো মা হয়। ওর এবার ৭টি বাচ্চা হয়। এতগুলো বাচ্চা দিয়ে ও শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে। সেদিন ছিল শুক্রবার যেদিন ওর ফ্লু পজিটিভ আসে। আমি অফিসে ছিলাম। আমার স্ত্রী বিকালে আমাকে জানায় যে টুকি বমি করছে এবং সে ৭ বার বমি করে ফেলেছে। টুকির ফ্লু ভ্যাকসিন দেয়া ছিল। প্রতি বছর ১ বার এই ভ্যাকসিন দিতে হয়। ওর নেক্সট ভ্যাকসিন ছিল জুন মাসে। তারপরও এত বার বমির কথা শুনে আমি ঘাবড়ে যাই। অফিস থেকে ফিরেই ওকে নিয়ে বিডি পেট কেয়ারে চলে যাই। ডাক্তার জ্বর মেপে দেখেন ১০৪ ডিগ্রী। সন্দেহজনক মনে হওয়ায় ফ্লু টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। তখনই ফ্লু টেস্ট করাই এবং ওর ফ্লু পজিটিভ আসে। আমার তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। ওর দুধের বাচ্চাগুলোর বয়স ১ মাসেরও কম। এছাড়া আমার বাসায় আরও ২টা প্রাপ্তবয়স্ক বিড়াল আছে। যাই হোক আমি আর দেরী না করে সেদিন রাত থেকেই ওর চিকিৎসা শুরু করে দিই। ডাক্তার এন্টিবায়োটিক ওষুধ এবং স্যালাইন দেন। ওর খাবার, পানি সব বন্ধ করে দেন। ১২ ঘন্টা পর পর এন্টিবায়োটিক এবং স্যালাইন দেয়া লাগবে মোট ৭ দিন। অর্থাৎ ওকে নিয়ে প্রতিদিন সকালে ও রাতে দুইবার করে বিডি পেট কেয়ারে নিয়ে আসতে হবে। এন্টিবায়োটিকগুলো মূলত ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এবং স্যালাইন মানুষের মতোই সিরিঞ্জ দিয়ে পুশ করতে হয়। তাই বাসায় এই চিকিৎসা করানো অসম্ভব। বিডি পেট কেয়ার আমার বাসা থেকে মোটামোটি ১০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। শনি, রবিবারে আমার উইকেন্ড থাকায় ওকে নিয়ে যাওয়া আসা সহজ হয়। বাইকে করে ওকে কাঁধের ব্যাগে বহন করি। বিড়ালের আলাদা ক্যারিং ব্যাগ আছে যেখানে এক সাইড ট্রান্সপারেন্ট থাকে এবং বাতাস চলাচলের জন্য ছিদ্র থাকে। সোমবার থেকে অফিস খুলে যাওয়ায় ধকল আরও বেড়ে যায়। রোজ সকাল ৮টায় উঠে ৯টার মধ্যে ওকে নিয়ে বের হতাম। আবার ১০টায় বাসায় ফিরে ১০ঃ৪০ এর মধ্যে অফিসে যেতাম। অফিস থেকে সন্ধ্যা ৭টায় বেরিয়ে বাসায় এসে আবার ৯টায় ওকে নিয়ে ভেট ক্লিনিকে যেতাম। এভাবেই ১ সপ্তাহ পরে শুক্রবার রাতে ওর এন্টিবায়োটিক শেষ হয়। ডোজ শেষ হওয়ার ২ দিন পর ওর FPV টেস্ট করাই এবং আলহামদুলিল্লাহ নেগেটিভ আসে। ৭ দিন পরে ওকে ফ্লু ভ্যাকসিন দেয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা সম্পন্ন হয়।

Image

চিকিৎসা ব্যয়ঃ

বিডি পেট কেয়ারে সার্ভিস চার্জ = ১৩ x ৩০০ = ৩,৯০০ টাকা,

ডাক্তারের ভিজিট + ফলোআপ = ৫০০ + ৩৫০ = ৮৫০ টাকা,

FPV টেস্ট ২ বার ২ x ৬৫০ = ১,৩০০ টাকা,

স্যালাইন ও ওষুধের খরচ = ১,৩৭০ টাকা,

সুস্থ হবার পর ভ্যাকসিন দেয়ার খরচ = ১,৬০০ টাকা,

বাইকে যাতায়াতে তেল খরচ = ৯০০ টাকা

তাহলে মোট খরচ = ৯,৯২০ টাকা।

Image

ওর চিকিৎসা চলাকালীন প্রথম ৫ দিন ওকে মুখে কোন খাবার বা পানি দিইনি। ৫ দিন পর ডাক্তারের পরামর্শে ওকে চিকেন ও পানি খেতে দিই। এই সময়টা বিড়ালকে খাবার না দেয়া ভালো। ও যদি খাবার খেয়ে বমি করে দেয় তাহলে আরও দূর্বল হয়ে পড়বে। তাই শুধু স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। অনেক বিড়াল ৩ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। ৩ দিন পার হলে আমি একটু আশাবাদী হই ওর সুস্থতার বিষয়ে। এই ৭ দিন ওকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা রুমে আটকে রাখি। ওর রুমে একটা লিটার বক্স দিয়ে রাখি। শুধু ডাক্তারের কাছে নেয়ার সময় ওকে দরজা খুলে ব্যাগে ভরে নিয়ে যেতাম। আবার ফিরে এসে ওই রুমেই ব্যাগ খুলে ওকে বের করতাম। বিড়ালের ফ্লু ছোঁয়াচে হওয়ায় ওকে বাকি বিড়াল এমনকি ওর দুধের বাচ্চাদের থেকেও আলাদা রাখতে হয়। ছোঁয়াচে হলেও এতে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না। তবে আক্রান্ত বিড়ালের সংস্পর্শে কোন মানুষ আসার পর সে অন্য বিড়ালকে ধরলে সেই বিড়ালও আক্রান্ত হতে পারে। তাই এই ৭ দিন টুকিসহ বাকি বিড়ালদের ধরার আগে ও পরে হাত ভালোভাবে সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতাম। বাসার ২টা প্রাপ্তবয়স্ক বিড়ালকেও আলাদা রুমে আটকে রেখেছি এই ৭ দিন। দিনে কয়েকবার খাবার দিতাম আর ১ বার ওদের লিটার পরিষ্কার করে দিতাম। ছেলে বিড়ালটা গত মাসে ভ্যাকসিন দেয়া ছিল দেখে ওকে নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম। চিন্তায় ছিলাম আরেকটা মেয়ে বিড়ালটা নিয়ে। ওর ভ্যাকসিনের মেয়াদ প্রায় শেষ। এই মাসেই ওকে ভ্যাকসিন দেয়ার ইচ্ছা ছিল। খাবার দেয়ার সময় ওদের দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতাম ফ্লুর কোন উপসর্গ দেখা দেয় কি না।

আমাদের সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল টুকির বাচ্চাগুলো। পারশিয়ান বা মিক্স পারশিয়ান বিড়াল গরুর দুধ হজম করতে পারে না। আর ওরা তেমন পছন্দও করে না। বিড়ালের বাচ্চার জন্য দুধের বিকল্প মিল্ক রিপ্লেসার পাওয়া যায়। সেগুলো কিনে আনলাম এবং ফিডারে করে বাচ্চাদের খাওয়াতে লাগলাম। আমাদের সৌভাগ্য যে ওরা ভালোভাবেই সেটা গ্রহণ করে। ৫ দিন পর ওদেরকে সিদ্ধ মুরগীর মাংস খেতে দিলাম এবং ওরা ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করল। আরও একটা সমস্যা হল বাচ্চাকে পি/পটি করানো। এই বয়সের বাচ্চার পি করার জায়গায় চেটে চেটে ওর মা পি করাত এবং সেগুলো খেয়েও ফেলত। আমরা তুলা ভিজিয়ে ঘষে ঘষে ওদের পি করাতে লাগলাম। খাওয়ানোর পর পরই ওদের পি করাতে হয়। এই কাজে ঘন্টাখানেক সময় ব্যয় হয় এবং প্রতি দিনে এই কাজ অন্তত ৪ বার করতে হয়। এই বিষয়ে ভালো টিউটোরিয়াল না পাওয়ায় নিজেরাই একটা ভিডিও করে ইউটিউবে দিই। কেউ মা ছাড়া বিড়ালছানাকে কীভাবে পটি করাবেন জানতে দেখতে পারেন ভিডিওটি। পরবর্তীতে আমরা ওদের লিটার ট্রেইন করতেও সক্ষম হই। এই বয়সী বাচ্চারা মাকে দেখে লিটার ব্যবহার করা শিখে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে ওরা একা একাই শিখে ফেলে। আমরা ওদের লিটারে দিয়ে বসে থাকতাম। ধীরে ধীরে ওরা এখানে পি/পটি করতে শুরু করে। বলা বাহুল্য অন্য বিড়ালগুলো থেকেও ওরা আলাদা ছিল। ওদেরকে নিয়ে আমরা বেশি ভয়ে ছিলাম। এই বয়সী বাচ্চা আক্রান্ত হলে সাধারণত বাঁচে না। আল্লাহর অসীম করুণা এবং আমার স্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রমেই মা ছাড়া বাচ্চাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হই।

Image

এবার বিড়ালের ফ্লু নিয়ে সবাইকে সাধারণ ধারণা দেবার চেষ্টা করব।

উপসর্গঃ

১। জ্বর আসা। বিড়ালের গায়ের সাধারণ তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। এর বেশি গা গরম হলে জ্বর ধরতে হবে। বিড়ালের জ্বর মাপার জন্য পায়ুপথে থার্মোমিটার দিয়ে মাপতে হয়।

২। বমি করা। ওরা এ সময় যা খায় বমি করে ফেলে।

৩। ডায়রিয়া। পটি একেবারে পানির মতো হয়।

৪। ক্ষুধামন্দা বা খাবারে অরুচি। সাধারণত বিড়াল কোন রোগ হলেই খাওয়া বন্ধ করে দেয়।

৫। দুর্বল হয়ে পড়া।

প্রতিকার ও করণীয়

আক্রান্ত হওয়ার ৩-৫ দিনের মধ্যে বিড়ালের এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে বিড়ালকে দ্রুত ডাক্তার দেখানো দরকার। ডাক্তার FPV টেস্ট করে পজিটিভ পেলে চিকিৎসা শুরু করে দিবেন। ৬ মাসের বেশি বয়সী হলে এবং ভ্যাকসিন দেয়া থাকলে বিড়ালের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ৩ দিন পর বিড়ালের স্বাস্থ্যের উন্নতি বা অবনতির উপর ভিত্তি করে ডাক্তার এন্টিবায়টিকের ডোজ বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিতে পারেন। এন্টিবায়োটিকের ডোজ শেষ হলে আবার FPV টেস্ট করাতে হবে। নেগেটিভ আসার পরে ডাক্তারের কথামতো বিড়ালকে ভ্যাকসিন দিয়ে দিতে হবে। বিড়ালের এই ফ্লু ভ্যাকসিন প্রতি বছর একবার দিতে হয়। এই ভ্যাকসিন দিলে বিড়ালের ফ্লু হবার সম্ভাবনা কম থাকে এবং হলেও বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

ওরা যেহেতু মুখে বলে নিজের অসুবিধার কথা বোঝাতে পারে না তাই উপসর্গগুলো নিয়মিত খেয়াল রাখতে হবে এবং দ্রুত ব্যাবস্থা নিতে হবে। প্রতি বছর ওদের ফ্লু ভ্যাকসিন দিতে হবে। বাহির থেকে বাসায় এসে ওদেরকে ধরার আগে হাত জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এছাড়া অন্য বিড়ালের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যারা বিড়াল পালেন তাদের কাছে বিড়াল সন্তানের মতোই প্রিয়। তাই বিড়ালের এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখলে আদরের বিড়ালটি ভালো থাকবে।

Image

There are few things in life more heartwarming than to be welcomed by a cat.

- Tay Hohoff

Related Articles

Image